টাইগার রবির ওপর হামলা: ভারতীয় দর্শকদের সঙ্গে হাতাহাতিতে হাসপাতাল, পিছনের ঘটনা ও বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের জন্য শিক্ষা
ক্রিকেটের মাঠে সমর্থকদের উন্মাদনা নতুন কিছু নয়। তবে কখনো কখনো এই উন্মাদনা সহিংসতায় রূপ নেয়, যা শেষ পর্যন্ত অপ্রত্যাশিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা দীর্ঘদিন ধরে তাদের প্রিয় দলের সমর্থনে মাঠে থাকলেও, এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা উদযাপনের মুহূর্তকে বিষাদময় করে তোলে। সম্প্রতি, বাংলাদেশের জনপ্রিয় ক্রিকেট সমর্থক মোহাম্মদ রবি, যিনি ‘টাইগার রবি’ নামে পরিচিত, ভারতের কানপুরে ক্রিকেট খেলার সময় ভারতীয় দর্শকদের হাতে হামলার শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। এই ঘটনা শুধু রবির জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের জন্যও একটি বড় ধাক্কা।
কানপুরে হাতাহাতি এবং হাসপাতাল যাত্রা
ঘটনার সূত্রপাত হয় ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ সালে, ভারতের কানপুরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় ও শেষ টেস্ট ম্যাচ চলাকালে। প্রথম দিনের মধ্যাহ্ন বিরতির সময় বৃষ্টি নামলে রবি গ্যালারির ভেতরে চলে যান। গ্যালারির এই সময়টি সাধারণত সমর্থকদের জন্য অপেক্ষার মুহূর্ত, যেখানে দুই দলের সমর্থকরা একে অপরের সঙ্গে ক্রীড়া নিয়ে আলাপ করে থাকেন। তবে সেইদিন ভাগ্যবশত ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। স্থানীয় কিছু ভারতীয় সমর্থকের সঙ্গে টাইগার রবির কথাকাটাকাটি শুরু হয়, যা পরে হাতাহাতিতে পরিণত হয়। এতে রবি মারাত্মকভাবে আহত হন এবং নিরাপত্তা কর্মীদের সাহায্যে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
রবির প্রাথমিক অভিযোগ অনুযায়ী, স্থানীয় দর্শকদের একটি দল তাকে আক্রমণ করে। তিনি জানান, পাঁজরের নিচের অংশে আঘাত পেয়েছেন এবং স্থানীয় পুলিশকে তার ওপর হামলার কথা জানিয়েছেন। যদিও ঘটনাটির বিশদ জানা যায়নি, তবে হাসপাতালের প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী রবির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না। তবুও, এমন একটি ঘটনার পর বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকরা দেশের বাইরে নিজেকে নিরাপদ মনে না করার একটি কারণ খুঁজে পেয়েছে।
ভারতীয় সমর্থকদের আগ্রাসী আচরণ: টাইগার রবির অভিজ্ঞতা
টাইগার রবি শুধু এই একটি ঘটনার ভুক্তভোগী নন। ২০২৩ সালে ভারতের পুনেতে অনুষ্ঠিত ওয়ানডে বিশ্বকাপের একটি ম্যাচেও বাংলাদেশি সমর্থক টাইগার শোয়েবকেও একই ধরনের আচরণের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ভারতের সমর্থকদের সঙ্গে কিছু তর্কাতর্কির পর শোয়েবকেও শারীরিক আক্রমণ করা হয় এবং তার টাইগার মাসকট ছিঁড়ে ফেলা হয়। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, ভারতীয় সমর্থকদের সঙ্গে বাংলাদেশের সমর্থকদের সম্পর্ক কিছুটা উত্তেজনাপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। বিশেষ করে ভারতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ম্যাচগুলোতে, যেখানে ভারতীয় দর্শকরা সংখ্যালঘু প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের বিরুদ্ধে আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারেন।
রবি অভিযোগ করেন, কানপুরের এই ঘটনাটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। তিনি তিন দিন আগেই তার ফেসবুক পোস্টে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, ভারতীয় সমর্থকরা তার ওপর আক্রমণ করতে পারে। ঘটনাচক্রে, তার আশঙ্কা বাস্তবে রূপ নেয়। তিনি আরো জানান, লাঞ্চ বিরতির আগে থেকেই ভারতীয় সমর্থকরা তাকে গালাগালি করছিল। লাঞ্চের সময় রবি শুধু বাংলাদেশি খেলোয়াড় নাজমুল হোসেন শান্ত এবং মমিনুল হকের নাম উচ্চারণ করতে থাকেন। এরপরই ভারতীয় দর্শকরা তার দিকে ধাক্কা দিতে শুরু করে এবং তার মাসকট ও পতাকা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করে। তিনি প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে, তারা তাকে মারধর করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং পরে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় হাসপাতালে নেওয়া হয়।
পুলিশের ভূমিকা ও বিবৃতি
ঘটনার পর স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে যে, রবিকে মারধর করা হয়নি। তাদের দাবি, রবি পানিশূন্যতার কারণে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। যদিও এই বক্তব্য অনেকের কাছেই সন্তোষজনক নয়, বিশেষ করে যেহেতু রবি সরাসরি ভারতীয় সমর্থকদের দ্বারা হামলার অভিযোগ করেছেন। পুলিশের এই বিবৃতি সামাজিক মাধ্যমে বেশ সমালোচিত হয়েছে। অনেকে বিশ্বাস করেন, সত্য ঘটনা আড়ালে রাখা হয়েছে, যা রবির মতো নির্দোষ সমর্থকদের জন্য বিপজ্জনক।
বাংলাদেশি সমর্থকদের জন্য সতর্কতা ও সমাধান
বাংলাদেশি ক্রিকেট সমর্থকরা প্রায়শই দেশের বাইরে দলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে গিয়ে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। টাইগার রবি, টাইগার শোয়েবের মতো অনেক প্রবাসী সমর্থকই তাদের প্রিয় দলকে সমর্থন করার জন্য অন্য দেশে গিয়ে সহিংস আচরণের শিকার হয়েছেন। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
১. স্থানীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি: আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচগুলোতে দর্শকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব। বাংলাদেশি সমর্থকদের আগ্রাসনের শিকার হওয়ার প্রবণতা যদি থেকে যায়, তবে আয়োজকদের উচিত নির্দিষ্ট এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা এবং উগ্র সমর্থকদের আচরণে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া।
২. প্রতিদ্বন্দ্বীতা নয়, সৌহার্দ্য: ক্রিকেট একটি ভদ্রলোকের খেলা হিসেবে পরিচিত। তাই দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও, সেটা যাতে সৌহার্দ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেটি নিশ্চিত করা উচিত। সমর্থকদের আচরণ যদি ক্রিকেটের চেতনাকে ব্যাহত করে, তাহলে সেটি খেলার মূল উদ্দেশ্যকে ধ্বংস করে দেয়।
৩. দূতাবাসের সহযোগিতা: দূর দেশে গিয়ে বাংলাদেশের সমর্থকরা যদি কোনো সমস্যার সম্মুখীন হন, তাহলে তাদের জন্য দূতাবাসের সহযোগিতা নিশ্চিত করা উচিত। রবির মতো কোনো সমর্থক যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়েন, তবে বাংলাদেশের দূতাবাসের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া জরুরি।
৪. দর্শকদের সচেতনতা ও শিষ্টাচার: প্রতিটি দেশের সমর্থকদের উচিত খেলার সৌন্দর্য বজায় রাখা। সাময়িক রাগ বা উত্তেজনা কখনোই সহিংসতায় রূপ নেওয়া উচিত নয়। খেলা শেষে দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে, যা ক্রীড়াজগতের মূল চেতনার সঙ্গে মানানসই।
টাইগার রবির ঘটনায় বাংলাদেশের জন্য কী বার্তা?
টাইগার রবির ঘটনা শুধু তার ব্যক্তিগত বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের জন্য একটি শিক্ষা। আন্তর্জাতিক খেলায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি সমর্থকদের উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর সঙ্গে তাদের সুরক্ষাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রবির মতো সমর্থকদের উপস্থিতি খেলায় প্রেরণা জোগায়, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আয়োজকদের আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
এছাড়াও, টাইগার রবির এই ঘটনা বাংলাদেশের সমর্থকদের জন্য একটি বার্তা। আন্তর্জাতিক ম্যাচে অংশগ্রহণ করার সময় উগ্র সমর্থকদের মুখোমুখি হওয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে। তবে এমন কোনো পরিস্থিতি যাতে খেলার আনন্দকে নষ্ট না করে, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা যাতে শান্তিপূর্ণভাবে খেলা উপভোগ করতে পারে, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব শুধু আয়োজকদের নয়, বরং আমাদের সবার।